ঈমান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
* প্রশ্ন-১। ঈমান কি?
উত্তরঃ- ঈমান শব্দের শাব্দিক অর্থ বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহ, নাবী-রাসুলগন, আখিরাত, ফিরিশতাগন ইত্যাদি কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনকে ঈমান বলে । ঈমান হচ্ছে তাছদীক বিল জিনান বা অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন, ইক্বরার বিল লিসান বা মুখের স্বীকৃতি এবং আমাল বিল আরকান বা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে কাজ করা।
* প্রশ্ন-২ মুমিন কে?
উত্তরঃ- কুরআন ও সাহীহ সুন্নাহতে উল্লেখিত ছয়টি রুকন এবং এগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের প্রতি যে যথার্থ ঈমান আনে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে তাকে মু'মিন বলা হয় প্রকৃত মু'মিনদের পরিচয়ে আল্লাহ্ (সুব) বলেনঃ
إنما المؤمنون الذين آمنوا بالله ورسوله ثم لم يرتابوا وجاهدوا بأموالهم وأنفسهم
في سبيل الله أولئك هم الصادقون [الحجرات/15]
“তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহ্র পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।” (সূরা হুজরাত ৪৯:১৫)
إنّما المؤمنون الذين إذا ذكر الله وجلت قلوبهم وإذا تليت عليهم آياته زادتهم إيمانا وعلى ربهم يتوكلون (2) الذين يقيمون الصلاة ومما رزقناهم ينفقون (3) أولئك هم المؤمنون حقا لهم درجات عند ربهم ومغفرة ورزق كريم
“মু’মিনতো তারাই, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর । আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ার দেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে। সে সমস্ত লোক যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। তারাই হল সত্যিকার মু'মিন! তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদেগারের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুষী।” (সূরা, আনফাল ৮৪২-৪)
* প্রশ্ন-৩। ঈমান কি বাড়ে কমে?
উত্তরঃ- হ্যা, ঈমানের কম বৃদ্ধি রয়েছে। আল্লাহর আনুগত্যের কিছু কথা ও কাজে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং অবাধ্যতার কথা ও কাজে ঈমান কমে যায় । যেমন আল্লাহ সুবঃ বলেনঃ
إنّما المؤمنون الذين إذا ذكر الله وجلت قلوبهم وإذا ثليث عليهم آياته زادتهم
إيمانا
“প্রকৃত মু'মিন তারাই যখন তাদের নিকটে আল্লাহর নাম স্বরণীত হয় তখন তাদের অন্তর কেঁপে উঠে। আর যখন তাদের নিকট তাঁর আয়াত পঠিত হয় তখন তাদের ঈমান বর্ধিত হয়।” (সূরা আল-আনফাল, ৮৪-২)
لا يزني الزاني وهو مؤمن ولا يسرق السارق وهو مؤمن ولا يشرب الخمر حين
يشربها وهو مؤمن
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ ব্যাভিচারী পরিপূর্ণ ঈমানদার অবস্থায় ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়না, চোর পরিপূর্ণ ঈমানদার অবস্থায় চুরি করেনা, এবং মদ্যপায়ী পরিপূর্ণ ঈমানদার অবস্থায় মদ পান করেনা (অর্থাৎ উক্ত সময়ে তাদের ঈমান অপূর্ণ ও দুর্বল হয়ে যায়)। (বুখারী ও মুসলিম)
* প্রশ্ন-৪ । ঈমানের আরাকান বা মৌলিক বিষয় কয়টি ও কি কি?
উত্তরঃ- ঈমানের আরাকান বা মৌলিক বিষয় ছয়টি ।
১। আল্লাহর প্রতি ঈমান,
২। ফিরিশতাগনের প্রতি ঈমান,
৩ কিতাবের প্রতি ঈমান,
৪। রাসুলগনের প্রতি ঈমান,
৫ । পরকালের প্রতি ঈমান,
৬। তাকদীর বা ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান ।
এ প্রসংগে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
ولكن البر من آمن بالله واليوم الآخر والملائكة والكتاب والتبيين
অর্থঃ বরং প্রকৃত পক্ষে সৎকাজ হল যে ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ফিরিশ্তাদের উপর এবং সমস্ত নাবী রাসূলগণের উপর (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৭৭)
তিনি আরো বলেনঃ
گل آمن بالله وملائكته وكتبه ورسله لا نفرق بين أحد من رسله
অর্থঃ সবাই বিশ্বাস রাখে, আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশ্তাদের প্রতি, তাঁর কিতাবের প্রতি, এবং তাঁর নাবীদের প্রতি তারা বলে আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোন তারতম্য করি না। (সূরা আল-বাক্কারা, আয়াত-১৮৫)
নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ
ما الإيمان ؟ قال ( أن تؤمن بالله وملائكته وبلقائه ورسله وتؤمن بالعبث
অর্থঃ ঈমান হলঃ তুমি আল্লাহ তা'আলা তাঁর ফিরিশ্তাগণ, কিতাব সমূহ, রাসূলগণ ও শেষ দিবসের (আখিরাতের) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে । আরো বিশ্বাস রাখবে ভাগ্যের ভাল মন্দের প্রতি। (মুসলিম শরীফ)
* প্রশ্ন-৫ । ঈমানের কয়টি শাখা-প্রশাখা রয়েছে, ঈমানের সর্বোত্তম শাখা কি?
উত্তরঃ- ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে, এর সর্বোত্তম শাখা হচ্ছে 'লা
ইলাহা ইল্লাল্লাহ'। নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ
عن أبي هريرة قال قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم- « الإيمان بضع وسبعون أو بضع وستون شعبة فأفضلها قول لا إله إلا الله وأدناها إماطة الأذى
عن الطريق (صحيح مسلم)
“ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা আছে, তার মধ্যে সর্বোত্তম হল 'লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহ' বলা । সর্বনিম্ন হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরানো।” (বুখারী ও মুসলিম)
* প্রশ্ন-৬। প্রকৃতপক্ষে কালিমা কয়টি, একে কি বলা কালিমাকে কিসের সাথে তুলনা করেছেন?
উত্তরঃ- আল্লাহ ঈমানের কালিমাকে উৎকৃষ্ট বৃক্ষের সাথে তুলনা করে বলেছেন,
ألم تر كيف ضرب الله مثلا كلمة طيبة كشجرة طيبة أصلها ثابت وفرعها في السّماء - تؤتي أكلها كل حين بإذن ربهـا ويـضرب الله الأمثـال للنّـاس لعلهـم
يتذكرون
“তুমি কি জাননা আল্লাহ কি ধরনের উদাহরণ পেশ করেছেন, কালিমা তাইয়্যেবা বা পবিত্র কালিমা একটি উৎকৃষ্ট গাছের ন্যায়, যার মূল খুবই দৃঢ় আর শাখা প্রশাখা উর্ধ্বাকাশের দিকে প্রসারিত। সে তার রবের নির্দেশে অহরহ ফলদান করে। আল্লাহ মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহন করতে পারে ।” (সূরা, ইবরাহীম ১৪:২৪-২৫)
প্রকৃতপক্ষে ঈমানের কালিমা একটি। আর তা হচ্ছে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' (আল্লাহ ছাড়া ইবাদত যোগ্য কোন ইলাহ নেই)। এক কালিমা তাইয়্যেবা বা কালিমাতুত তাওহীদ বলে। আল্লাহ এক উৎকৃষ্ট গাছের সাথে তুলনা করেছেন এছাড়া কালিমায়ে তামজীদ, রাদ্দে কুফর এসবের অস্তিস্ত্র কুরআন হাদীসে কোথাও নেই।
* প্রশ্ন-৭। কে ঈমানের স্বাদ লাভ করে?
উত্তরঃ- প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি ঈমানের মজা ও স্বাদ লাভ করে। সে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে এ স্বাদকে। তাদের ব্যাপারে রাসুল (সা:) বলেন,
ثلاث من كن فيه وجد حلاوة الإيمان أن يكون الله ورسوله أحب إليه مما سواهما وأن يحب المرء لا يحبه إلا لله وأن يكره أن يعود في الكفر كما يكره
أن يقذف في النار
“যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে ঈমানের স্বাদ ও মজা পাবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে অন্য সব কিছুর চেয়ে প্রিয় হবে। সে কাউকে ভালবাসবে তো শুধু আল্লাহর জন্যই ভালবাসবে। আল্লাহ তাকে কুফর থেকে মুক্তি দেয়ার পর সে কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে এতটাই অপছন্দ করবে যেমন সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে।” (বুখারী ও মুসলিম)
তিনি (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন, “যে আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে রাসুল হিসেবে স্বীকার করে ও মেনে সন্তুষ্ট সে ঈমানের স্বাদ ও মজা আস্বাদন করে
* প্রশ্ন-৮। ঈমানের আলামত কি?
উত্তরঃ- একজন ঈমানদারকে যখন ভাল কাজ আনন্দ দেয় এবং মন্দ কাজ তার কাছে খারাপ মনে হয় তখন সে বুঝবে তার ঈমান আছে। উসামা (রা) বর্ননা করেন, এক ব্যক্তি এসে রাসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, ঈমান কি? ঈমানের আলামত কি? উত্তরে রাসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
عن أبي أمامة أن رجلا سأل رسول الله صلى الله عليه وسلم ما الإيمان قال إذا سرتك حسنئك وساءتك سيئتك فأنت مؤمن (مسند أحمد)
‘তোমার ভাল কাজ তোমাকে আনন্দ দিলে আর খারাপ কাজ তোমার কাছে খারাপ লাগলে তুমি মু'মিন ।' (আহমাদ)
আজ এই পর্যন্তই। কোন ঈমান বিষয়ে কোন কিছু না বুঝে থাকলে কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন