শবে বরাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

 

শবে বরাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

শবে বরাতঃ

শা'বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে আরবীতে ৬ শাবানের মধ্যরজনী বলা হয়। বাংলাদেশসহ পাক ভারত উপমহাদেশে এ রাতটি 'শবে বরাত' হিসেবে পরিচিত। 'শবে বরাত' শব্দ দু’টি ফার্সী 'শব' মানে রাত আর 'বরাত' মানে ভাগ্য। একত্রে শব্দ দু'টির অর্থ হচ্ছে ভাগ্যরজনী। যারা এ রাতটি উদযাপন করে তারা বিশ্বাস করে যে, এ রাতে মানুষের আগামী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তাই তাদের ধারণা মতে এ রাতকে শবে বরাত- মানে ভাগ্য রজনী বলা হয় । এ রাতকে পবিত্র মনে করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে উদযাপন করা হয় ।

শবে বরাত উপলক্ষে যা করা হয়ঃ

সুর্যাস্তের পর গোসল করা, রাতে সমবেতভাবে মসজিদে অবস্থান করে সালাত, যিকর, কুরআন তেলাওয়াত, কবর যিয়ারত, মিলাদ, ভোর রাতে সমবেত মুনাজাত করা, পরের দিন সাওম পালন করা ইত্যাদি। এদিন ব্যাপকভাবে হালুয়া রুটি তৈরী করা ও বিতরণ করা। শবে বরাতকে ঘিরে যে আকীদা পোষণ করা হয় এবং এ রাতটিকে যেভাবে উদযাপন করা হয় কুরআন-সুন্নাহ তে এর কোন ভিত্তি আছে কি?

মুসলিম হিসেবে আমাদের ঈমানী দায়িত্ব আমরা যে কোন বিশ্বাস পোষণ করব তা কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতেই করব। যে কোন কাজ করব তা কুরআন-সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতেই করব। সওয়াবের আশায় কোন কাজ করলে তা কুরআন সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত কিনা তা দেখতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা যা সমর্থিত তাই ইবাদত । যে কাজের পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর সমর্থন নেই তা ইবাদত নয় বরং তা বিদআত । তা কোনো সওয়াবের কাজ হতে পারে না।

শবে বরাতকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে জঘণ্য অপরাধঃ

শবে বরাতকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হলো, শবে বরাত প্রমাণ করার জন্য পবিত্র কুরআনের সুরা দুখানের তিন ও চার নং আয়াতকে দলীল প্রমাণ হিসেবে পেশ করা। ইয়াহুদী-খ্রিস্টান ও পূর্বের আহলে কিতাবরা যেভাবে নিজেদের মতলব হাসিলের জন্য আল্লাহর কালামকে বিকৃত করে, দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে, মনগড়া ব্যাখ্যা করে নিজেদের পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করেছে ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান মুসলিম সমাজের এক শ্রেণীর রেডিও টেলিভিশনে বক্তব্য প্রদানকারী ও পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখক আলেম শবে বরাত'কে প্রমাণ করার জন্য কুরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধে জোর করে সুরা দুখানের তিন নং ও চার নং আয়াতকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে। অথচ শবে বরাতের কথা পবিত্র কুরআনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। 

সুরা দুখানের যে আয়াত দুটো শবে বরাতের সপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করা হয় তা যে, শবে কদর সম্পর্কে নাজিল হয়েছে, শবে বরাত সম্পর্কে নয় তা একজন সাধারণ জাহেল, মুর্খ লোকও একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবে। সেকারণে প্রথমেই আমরা উক্ত আয়াতদ্বয়ের সঠিক তাফসীর পাঠকদের সামনে তুলে ধরবো। অতঃপর ‘শবে বরাতে' আমাদের করণীয় ও বর্জণীয় বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে তুলে ধরবো। ইনশাআল্লাহ!

‘শবে বরাত মর্যাদার রাত, এ রাতে ভাগ্য বন্টন হয়' এ ধারণার ভিত্তি কি? যারা শবে বরাতকে মর্যাদার রাত মনে করে এবং এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, এ রাতে মানুষের আগামী এক বছরের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা হয়, তারা তাদের এ ধারণা ও বিশ্বাসের পক্ষে কুরআন মাজীদের সূরা দুখানোর নিচের আয়াতগুলোকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে। পবিত্র কুরআনের আল্লাহ্ (সুব.) ইরশাদ করেনঃ

المبين - إنا الزلناه في ليلة مباركة إنا كنا منذرين- فيها يفرق كـل

حم – والكتاب

- أمرا من عندنا 

‘হা-মীম । সুস্পষ্ট কিতাবের কসম! নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, আমার নির্দেশে।' (সুরা দুখান: ১-৬)

শবে বরাতের মর্যাদা ও এ রাতে সকল বিষয়ে আল্লাহ্ (সুব.) থেকে চূড়ান্ত ফায়সালা হয় বলে যারা বিশ্বাস করে তারা বলেন যে, আয়াতে উল্লেখিত ‘লাইলাতুন মুবারাকাতুন' বরকতময় রাত হচ্ছে মধ্য শাবান রজনী অর্থাৎ শবে বরাত । আর এ রাতেই প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহর ফয়সালা চূড়ান্ত হয়।

আয়াতে উল্লেখিত বরকতময় রাত কোনটি?

একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, সুরা দুখানের তিন নং আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে- “নিশ্চয়ই আমি ইহা (কুরআন) এক বরকতময় রাতে নাযিল করেছি।' এ

আয়াতের আগের আয়াতে ইরশাদ হ য়েছে- 'সুসুস্পষ্ট কিতাবের শপথ' । এ আয়াত সহ মোট তের বার আল্লাহ (সুব.) তাঁর কিতাব কুরআন মাজীদকে ‘কিতাবুম মুবীন' মানে সুস্পষ্ট কিতাব হিসেবে অভিহহিত করেছেন। এই সুস্পষ্ট কুরআনে খুবই সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কুরআন নাজিল হয়েছে রামাদান মাসে, শাবান মাসে নয়। আর কুরআন নাজিলের রাত যেটি ‘লাইলাতুম মুবারাকা' বা বরকতময় রাত সেটিই। এখন আমরা সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী কিতাবকে স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করবো, তুমি কোন মাসে নাজিল হয়েছো? রামাদান মাসে না শাবান মাসে? সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী কিতাব স্পষ্টভাবে উত্তর দিবে-, রমযান মাস- যাতে কুরআন فيـه নাযিল হয়েছে ।' (বাকারা ২:১৮৫) 

এবারে আমরা সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী কিতাবকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করবো, আমরা বুঝলাম তুমি রামাদান মাসে অবতীর্ণ হয়েছো । তবে রামাদানের কোন সময়ে নাজিল হয়েছো? রাতে না দিনে? রাতে হলে কোন রাতে? উত্তরে সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী কিতাব কুরআন মাজিদ স্পষ্টভাবে উত্তর দিবে- নিশ্চয় আমি ইহা (কুরআন) কদরের রাতে নাযিল করেছি।' (সুরা ক্বদর: ১) 

এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কুরআন মাজীদ নাজিল হয়েছে রামাদান মাসের লাইলাতুল কদর বা শবে কদরে শবে বরাতে নয় । আর সুরায়ে দুখানের তিন নং আয়াতের শুরুতে কুরআন নাজিলের রাতকেই লাইলাতুম মুবারাকা বলা হয়েছে । ইরশাদ হয়েছে:

حم – والكتاب المبين - إنا أنزلناه في ليلة مباركة

‘হা-মীম । সুস্পষ্ট কিতাবের কসম! নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে।' (সুরা দুখান: ১-৬)

এখানে পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছে 'সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ। তার পরই বলা হয়েছে, “নিশ্চয় আমি ইহা বরকতময রাতে নাযিল করেছি। কুরআন যে মহান আল্লাহর কিতাব, তিনি নিজে সুস্পষ্টভাবে বলছেন, কুরআন রমযান মাসে নাযিল হয়েছে। রমযানের কোন দিন বা রাতে নাযিল হয়েছে তাও সুস্পষ্ট করে বলেছেন যে, তিনি কদরের রাতে নাযিল করেছেন এত স্পষ্ট করে বলার পর 'বরকতময় রাত' বলতে কোন রাতকে বুঝানো হয়েছে তাও সুস্পষ্ট । এ রাত অন্য কোন রাত নয়, এ বরকতময় রাত হচ্ছে ‘কদরের রাত।' 

তাফসীর বিশারদগণের মতে সব চেয়ে বিশুদ্ধ, নির্ভরযোগ্য সঠিক তাফসীর হচ্ছে কুরআন দিয়ে কুরআনের তাফসীর। কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে  কুরআন নাযিল হয়েছে রমযান মাসে অপর দিকে আরো নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে কুরআন কদরের রাতে নাযিল হয়েছে কদর রাত যে রমযান মাসে এ ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ নেই। তাই কুরআন অনুযায়ীই সূরায়ে দুখানের তৃতীয় আয়াতে উল্লেখিত ‘বরকতময় রাত’ হচ্ছে কদরের রাত। অন্য কোন মাসের কোন রাত নয়। এখন আমরা ইসলামের গ্রহণযোগ্য তাফসীরের কিতাবসমূহ থেকে জানার চেষ্টা করবো সুরা দুখানে বর্ণিত a saiy 'বরকতময় রাত' বলতে কোন রাতকে বুঝানো হয়েছে। শবে বরাত না শবে কদর ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঈমান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

বিদআত থেকে সাবধান হতে করনীয়