'দ্বীন' শব্দের অর্থ কি?
প্রশ্ন: 'দ্বীন' শব্দের অর্থ কি?
উত্তর: 'দ্বীন' শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে । কুরআন মজীদে বিভিন্ন অর্থেই এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে । কোন্ স্থানে কি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঐ শব্দের অর্থ সঠিকভাবে বুঝার উপায় নেই । 'দ্বীন' শব্দের কয়েকটি অর্থ কুরআন পাকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় নিম্নে তা পূর্ণ বাক্য থেকে বুঝা যাবে । যে বাক্যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা
উল্লেখ করা হলো:
এক: প্রতিদান, প্রতিফল, বিনিময় ইত্যাদি ।
দুই: আনুগত্য বা হুকুম মেনে চলা । তিন: আনুগত্য করার বিধান বা আনুগত্যের নিয়ম (যা ওহীর মাধ্যমে নির্ধারিত)।
চার: আইন অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে নিয়মের অধিনে চলে, অনুরূপ সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয় (যা ওহীর মাধ্যমে নয় বরং মানুষের সৃষ্টি করা)।
কুরআন পাকের কয়েকটি আয়াত থেকে দ্বীন শব্দের এসব অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় ।
প্রথম অর্থ: প্রতিদান বা বদলা
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে:
অর্থ: “প্রতিদান দিবসের মালিক। ৬
তাফসীরে বাইযাভীতে বলা হয়েছে:
ويوم الدين يوم الجزاء ومنه «كما تدين تدان» وبيت الحماسة : ولم يبـق سـوى
العدوان دناهم كما دانوا
* সুরা ফাতিহা ১:৪ ।
ইয়াউমুদ দ্বীন হচ্ছে 'ইয়াউমূল জাযা' বা বিনিময় দিবস। এ অর্থেই একটি আরবী প্রবাদ রয়েছে 'কামা তাদ্বীনু তুদ্বানু' অর্থাৎ 'যেমন কর্ম তেমন ফল'। এ অর্থেই আরবী সাহিত্যের প্রসিদ্ধ কিতাব 'হামাসাহ’তে বলা হয়েছে: ‘শত্রুতা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না, তাই আমরা তাদেরকে কর্মানুযায়ী উচিৎ বিনিময় দান করেছি ।”৭
অপর এক আয়াতে বলা হচ্ছে:
{অর্থ: “না, তা নয়, বরং তোমরা প্রতিদানকে মিথ্যা মনে করেছো ।" এ আয়াত দুটিতে দ্বীন শব্দের অর্থ প্রতিদান, প্রতিফল, বদলা ইত্যাদি । আখেরাতে মানুষের কাজের যে বদলা দেয়া হবে তাই এখানে বুঝানো হয়েছে ।
দ্বিতীয় অর্থ: আনুগত্য
আরবী ভাষার প্রসিদ্ধ অভিধান 'লিসানুল আরব' এ বলা হয়েছে:
ثم دانت بعد الرباب أي ذلت له وأطاعته و الدين من هذا إنما هو طاعته والتعبـد
له و دانه ديناً أي أذله واستعبده
“১১ শব্দের একটি অর্থ বা 'সে আনুগত্য করল’ । এ থেকে ১১ মানে । বা আনুগত্য করা, বিনয় প্রকাশ করা । নিজেকে কারো গোলাম বানানো ।”৯
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে:
الله يبغون وله أسلم من في السماوات والأرض طوعا وكرها وإليـه {أفغير دين "
يرجعون} [آل عمران : ۸۳]
অর্থ: “তারা কি আল্লাহর দ্বীনের (আনুগত্যের) পরিবর্তে অন্য কিছু তালাশ করছে? অথচ আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে সেগুলো ইচ্ছায় বা তাফসীরে বাইযাভীর সুরা ফাতেহার ৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
সূরা ইনফিতার: ৮২:৯। লিসানুল আরব ১৩ খন্ড ১৬৪ পৃষ্ঠা, দ্বীন শব্দের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
অনিচ্ছায় তাঁরই আনুগত্য করে এবং তাদেরকে তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন এখানে “দ্বীন” শব্দটি আত্মসমর্পণ বা আনুগত্য অর্থেই ব্যবহার করা অপর আয়াতে বলা হয়েছে
অর্থ: “অতএব আল্লাহর ‘ইবাদাত' কর তাঁরই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে ।”১১ অপর আয়াতে বলা হয়েছে:
{وقاتلوهم حتى لا تكون فتنة ويكون الدين لله} [البقرة : 193]
অর্থ: “আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যে পর্যন্ত না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দ্বীন (সকল প্রকারের আনুগত্য) আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায় । ১২ এখানে ফিনা অর্থ আল্লাহর আনুগত্যের পথে বাধা সৃষ্টিকারী ইসলাম বিরোধী শক্তি যুদ্ধের নির্দেশ দিয়ে এখানে বলা হয়েছে যে, বিরোধী শক্তিকে এমনভাবে দমন কর যাতে আল্লাহর আনুগত্য করতে কেউ বাধা দিতে না পারে।
এ তিনটি আয়াত নমুনা স্বরূপ দেয়া হলো। কুরআনে এ জাতীয় আয়াত বহু আছে। উল্লেখ্য যে, আনুগত্যই হলো 'দ্বীন' শব্দের প্রধান অর্থ।
তৃতীয় অর্থ: আনুগত্যের বিধান বা জীবন ব্যবস্থা (ওহীর মাধ্যমে নির্ধারিত)
[[11] { অর্থ: “নিশ্চই আল্লাহর নিকট ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন (আনুগত্যের বিধান বা জীবন ব্যবস্থা) ।”১৩
এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে তাফসীরে বাইযাভীতে বলা হয়েছে:
সুরা আল ইমরান ৩:৮৩।
সুরা আয যুমার ৩৯:২
সুরা আল বাক্কারা ২:১৯৩ ।
সুরা আলে ইমরান ৩:১৯।
لا دين مرضي عند الله سوى الإسلام ، وهو التوحيد والتدرع بالشرع الذي جاء
به محمد صلى الله عليه وسلم
অর্থ: “আল্লাহর কাছে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন গ্রহণযোগ্য নয় । আর তা হলো তাওহীদ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আনীত জীবন বিধানকে লৌহ বর্ম পরিধান করার ন্যায় গ্রহণ করা ।”১৪
অপর আয়াতে একই অর্থে ব্যবহার হয়েছে:
دينا فلن يقبل منه وهو في الآخرة من الخاسرين} [آل
{ومن يبتغ غير الإسلام
অর্থ: “যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) চায়, তার কাছ থেকে তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”১৫
অর্থাৎ আল্লাহর নিকট একমাত্র জীবন ব্যবস্থা বা আনুগত্যের বিধান হচ্ছে ইসলাম।
অপর আয়াতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে:
لكم من الدين ما وصى به لوحا والذي أوحينا إليك وما وصينا به إبراهيم
{شرع
وموسى وعيسى أن أقيموا الدين ولا تتفرقوا فيه} [الشورى : 13]
অর্থ: “তিনি তোমাদের জন্য দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; (তা হচ্ছে ঐ জীবন ব্যবস্থা) যার ব্যাপারে তিনি নূহ (আ:) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন । আর আমি (আল্লাহ) তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দ্বীন কায়েম করো এবং এই ব্যাপারে (দ্বীন কায়েম করতে গিয়ে) একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না ।”১৬
তাফসীরে বাইযাভী
সুরা আল ইমরানের ১৯ নং আয়াতের তাফসীরে দ্রষ্টব্য ।
সুরা আলে ইমরান ৩:৮৫।
সুরা শু'রা ২৬:১৩।
অর্থাৎ আল্লাহ (সুব:)সব নবীকেই তাঁর নাজিলকৃত জীবন ব্যবস্থা কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে:
{هو الذي أرسل رسوله بالهدى ودين الحق ليظهره على الدين كله ولـو كـرة [9] {
অর্থ: “তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপর এই দ্বীনকে বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। ১৭ সাথে সাথে এই ঘোষণাও দিলেন যে,
অর্থ: “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম ।"১৮ অর্থাৎ জীবনে একমাত্র আনুগত্যের বিধান যাতে পালন করা যায় এবং কোন ক্ষেত্রেই অন্য কোন বিধান থেকে কিছু নিতে না হয় সেজন্য তোমাদের জীবন বিধান পূর্ণ করে দিলাম । উপরের আয়াতগুলোর মাধ্যমে 'দ্বীন' শব্দের অর্থ 'জীবন ব্যবস্থা' এটি প্রমাণিত হলো।
চতুর্থ অর্থ: মানব রচিত আইন, রাষ্ট্র ও জীবন ব্যবস্থা দ্বীন শব্দটি যেভাবে আল্লাহ প্রদত্ত আইন, বিধান, রাষ্ট্র ও জীবন ব্যবস্থা অর্থে ব্যবহৃত হয় তেমনিভাবে মানব রচিত আইন, বিধান, রাষ্ট্র ও জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন: পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
অর্থ: “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন আর আমার জন্য আমার দ্বীন ।”১৯
১৭. সুরা সাফ ৬১:৯।
১৮. সুরা আল মায়েদা ৫:৩ ।
১৯. সুরা কাফিরূন ১০৯:৬।
এ আয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনে হক্ককেও দ্বীন বলা হয়েছে। মানব রচিত দ্বীনে বাতিলকেও দ্বীন বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে:
{وقال فرعون ذروني أقتل موسى وليدغ ربه إني أخاف أن يبدل ديـكم أو أن
يظهر في ا
অর্থ: “আর ফির'আউন বলল, 'আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসাকে হত্যা করবো এবং সে তাঁর রবকে ডাকুক; নিশ্চয়ই আমি আশঙ্কা করছি, সে তোমাদের দ্বীন পাল্টে দেবে অথবা সে যমীনে বিপর্যয় ছড়িয়ে দেবে।”২০ এখানে ফির'আউন তৎকালীন সমাজের মানব রচিত আইন, বিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দ্বীন বলে উল্লেখ করেছে ।
এমনিভাবে, ইউসূফ (আ) এর ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ (সুব:) পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন:
الملك [يوسف : 76[ ما كان ليأخذ أخاه في دين ا
অর্থ: “বাদশার আইনে অন্য কাউকে ধরা যায় না
অর্থাৎ যে চুরি করেছে তাকেই ধরতে হবে। দেশের আইনে দোষীর বদলে
অন্য কাউকে ধরা যায় না।” এ আয়াতে 'দ্বীন' শব্দটি মানুষ কর্তৃক রচিত
আইন-বিধান এর অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে ।
অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:
قاتلوا الذين لا يؤمنون بالله ولا باليوم الآخر ولا يحرمون ما حرم الله ورسـوله
অর্থ: “তোমরা যুদ্ধ কর সে সকল লোকদের বিরূদ্ধে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে প্রতি ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না এবং সত্য দ্বীন গ্রহণ করে না। ২২ এই আয়াতের মধ্যেও দ্বীন শব্দটি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
২০. সুরা মু'মিন ৪০:২৬।
২১. সুরা ইউসুফ ১২:৭৬ ৷
২২. সুরা তাওবা ৯:২৯।
মোটকথা: উপরোক্ত আয়াতগুলোতে 'দ্বীন' শব্দটি মানুষ কর্তৃক রচিত রাষ্ট্র, আইন, বিধান ও জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন