যেখানে 'দ্বীনে বাতিল' কায়েম বা বিজয়ী আছে সেখানে 'দ্বীনে হকের' অবস্থা কিরূপ?

 

যেখানে 'দ্বীনে বাতিল' কায়েম বা বিজয়ী আছে সেখানে 'দ্বীনে হকের' অবস্থা কিরূপ?

বর্তমান মুসলিম বিশ্বে দ্বীনে হকের অবস্থা 

 

 প্রশ্ন: যেখানে 'দ্বীনে বাতিল' কায়েম বা বিজয়ী আছে সেখানে 'দ্বীনে হকের' অবস্থা কিরূপ?


উত্তর: এটা প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না। 'দ্বীনে হক' সেখানে দ্বীনে বাতিলে’রই অধীনে রয়েছে। অর্থাৎ 'দ্বীনে হক' বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ সকল মুসলিম দেশগুলোতে ততটুকুই বেঁচে আছে, যতটুকু দ্বীনে বাতিল অনুমতি দিয়েছে। দ্বীনে হকে’র ততখানি অংশই চালু আছে, যতটুকুতে দ্বীনে বাতিলের কোন আপত্তি নেই ।

অর্থাৎ 'ইসলাম' বর্তমান মুসলিম দেশগুলোতে ঐ পরিমাণই টিকে আছে, যতটুকু দ্বীনে বাতিল বাঁধা দেয় না। আর 'দ্বীনে বাতিল’ ‘দ্বীনে হকে’র শুধু ততখানিই অনুমতি দেয়, যতখানি ওদের নিজেদের তৈরী করা মানব রচিত সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭' এর দ্বিতীয় ধারাতে বলা হয়েছে, 'জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে ।

এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে 'দ্বীনে বাতিল' 'দ্বীনে হকে'র ততটুকুই সমর্থন করে, যতটুকু তার সাথে সামঞ্জস্য হয়। বাতিল সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিপূর্ণ ইসলামকে কখনোই সহ্য করতে রাজী হতে পারে না। বাতিল সমাজের কর্তারা ইসলামের ততটুকু অংশকেই সহ্য করে, যতটুকুতে দ্বীনে বাতিলের কোন ক্ষতি হয় না। বাংলাদেশে ইসলামের যেসব খেদমত হচ্ছে, তাতে বাতিল যদি শংকিত হতো, তাহলে এসবকে সহ্য করতো না। মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, ওয়াজ ও তাবলীগ দ্বারা বাতিল সমাজ ব্যবস্থা উৎখাত হবার কোন ভয় নেই বলেই এসব ইসলামী কাজকে বাঁধা দেয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ বাতিলের পক্ষ থেকে আপত্তি নেই বলেই এগুলো টিকে আছে । বাতিলের সাথে এসবের কোন টক্কর বা সংঘর্ষ নেই ।

বাংলাদেশে দ্বীন ইসলামের কী দশা তা সামান্য আলোচনা দ্বারাই স্পষ্ট হবে। ইসলাম হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন বিধান। ইসলামকে যদি বিরাট একটি দালানের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে কালেমা, সালাত, সাওম, হজ্জ ও যাকাত সে বিরাট বিল্ডিং এর ভিত্তি মাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথাই বলেছেন:

الإسلام علـى خـمـر بني

 অর্থাৎ কালেমা, সালাত ইত্যাদি পাঁচটি জিনিস দ্বারা ইসলামী জীবন বিধানের ভিত্তি রচিত হয় মাত্র । শুধু এ ভিত্তিটুকুই ইসলাম নয়। ইসলামের মহান সৌধের সঠিক ধারণা আজ আলেম সমাজের মধ্যেও সকলের নেই। বাংলাদেশে ইসলামের গোটা বিল্ডিং এর তো কোন অস্তিত্বই নেই। শুধু ভিত্তিটুকুর অবস্থাই আলোচনা করে দেখা যাক যে বাংলাদেশে দ্বীনে হক্বের অবস্থা কত করুণ ।

‘কালেমা তাইয়্যেবা' যে গোটা জীবনের চিন্তা ও কাজের ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ করবে এবং এই কালেমা কবুল করার অর্থ যে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করার অঙ্গীকার করা একথা দ্বীনদার বলে পরিচিত মুসলমানদের মধ্যেও অনেকের জানা নেই। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও কালেমার এ ব্যাপক অর্থ শেখানো হয় না। শিক্ষিত সমাজ যদি কালেমার এ মর্ম না জানে, তাহলে এ দোষ কার? দেশের সরকার ও শিক্ষা ব্যবস্থাই কি এর জন্য দায়ী নয়?

দ্বীনে ইসলামের প্রথম পাঠই কালেমা তাইয়্যেবা । যে নীতি অনুযায়ী গোটা জীবন যাপন করতে হবে। তাই যদি শেখার কোন ব্যবস্থা না হয়, তাহলে মানুষ ইসলামকে জীবনে কি করে পালন করবে? এরপর সালাত হলো দ্বিতীয় ভিত্তি। আল্লাহ পাক মুসলিমদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাআতের সাথে ফরয করেছেন। ফরয মানে হলো অবশ্য কর্তব্য বা অপরিহার্য দায়িত্ব। আল্লাহ সালাতকে ফরযের গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে সালাতের পজিশন কী?

সাধারণভাবে এ দেশে সালাত মুবাহ (বৈধ) অবস্থায় আছে। অর্থাৎ করলে ক্ষতি নেই এবং না করলেও দোষ নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে সালাত পড়া মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। পিয়ন জামায়াতে যেয়ে সালাত পড়া হারাম বা নিষিদ্ধের পর্যায়ে আছে। তাই অনেকে ডিউটি থাকাকালে সালাত কাযা করতে বাধ্য হয় ।

‘দ্বীনে বাতিলের' অধীনে আল্লাহর দেয়া এ হুকুমের সাথে এরূপ ব্যবহার করাই স্বাভাবিক। যদি ‘দ্বীনে হক' এ দেশে কায়েম থাকতো তাহলে সালাতকে ফরজ হিসেবেই মর্যাদা দেয়া হতো। সর্বত্র সবাই যাতে সালাত ঠিক মতো আদায় করতে পারে সে ব্যবস্থা করা হতো। কর্তারা নিজে নিয়মিত সালাত আদায় করতো। সালাত যে নীতি অনুযায়ী জীবন যাপনের শিক্ষা দেয় তা সালাত আদায়কারীদের জীবনে বাস্তবে দেখা যেতো ।

এ সমাজে সাওমের (রোজার) অবস্থা কী? ইসলামের এ ভিত্তিটিও সালাতের মতোই 'মুবাহ' অবস্থায় আছে, অথচ আল্লাহ (সুব:)রমযান মাসের সাওমকে ফরজ করেছেন। 'দ্বীনে হক’ কায়েম থাকলে সমাজে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হতো যার ফলে দিনের বেলা হোটেলের দরজায় পর্দা অধিকার ঝুলিয়ে খাওয়ার মতো মুনাফেকী করা কোন মুসলমানের পক্ষে সম্ভব হতো না। সাওমের উদ্দেশ্য যে নৈতিক উন্নয়ন, বর্তমানে সে নৈতিকতার কোন মূল্যই সমাজে নেই । প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে বিবেকের শক্তি বৃদ্ধি করাই সাওমের অন্যতম বড় উদ্দেশ্য। ভাল ও মন্দের বিচারজ্ঞান দিয়ে মানুষকে তৈরী করা হয়েছে। তাই মানুষকে বিবেকবান হিসেবে গড়ে তুলবার জন্যই সাওমের প্রয়োজন। কিন্তু দ্বীনে বাতিলের নিকট বস্তুগত সুখ ও প্রবৃত্তির পূঁজাই বড়। তাই “রমযানের পবিত্রতা রক্ষার" লোক দেখান কিছু অভিনয় চলে এবার হজ্জের অবস্থা দেখা যাক। যাদের হজ্জ করা উচিত তাদের উপর আল্লাহর নির্দেশ যে, মক্কা মুকাররামায় গিয়ে হজ্জ আদায় করতে হবে। কিন্তু আল্লাহর এ আদেশটি দ্বীনে বাতিলের অধীন । বাতিল যদি অনুমতি না দেয়, তাহলে হজ্জে যাওয়া যাবে না। যদি দ্বীনে হক দেশে কায়েম থাকতো তাহলে যাদের হজ্জে যাবার ক্ষমতা আছে তাদেরকে সরকারীভাবে হজ্জে যাবার জন্য তাকিদ দেয়া হতো ।

যাকাতের অবস্থা আরও করুণ। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে যাকাত ব্যবস্থা হলো সামাজিক নিরাপত্তার (Social security) বিধান। যাদের প্রয়োজনের চেয়ে আয় কম এবং কোন না কোন কারণে যারা অভাবগ্রস্ত ও ঋণী হয়ে পড়েছে তাদের জন্য ইসলামী সরকারের দায়িত্ব হলো যাকাত দেয়ার যোগ্য লোকদের নিকট থেকে যাকাতের টাকা আদায় করে যাকাত গ্রহণের যোগ্য লোকদের নিকট পৌছিয়ে দেয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:  অর্থাৎ: তাদের ধনীদের থেকে নেয়া হবে এবং তাদের গরীবেদের মধ্যে বণ্টন করা হবে ।

যাকাত অন্যান্য ট্যাক্সের মতো নয়। যে কোন সরকারি কাজে যাকাতের টাকা খরচ করার অনুমতি নেই। কুরআনে খরচের জন্য যে আটটি খাতের কথা উল্লেখ রয়েছে তার বাইরে যাকাতের খরচ করার কোন সরকারের নেই। যাকাত ব্যবস্থা ঠিকমতো চালু করা হলে সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি ও বেকার সমস্যা থাকতেই পারে না ।

কিন্তু 'দ্বীনে হক' চালু নেই বলে যাকাতের মতো মহান ব্যবস্থাটিও ইসলামের কলংক বলে ধারণা হওয়ার কারণ ঘটেছে। বর্তমান বাতিল সমাজ ব্যবস্থায় যে নিয়মে যাকাত চালু আছে তাতে মনে হয় যে, যাকাত যেন গরীবদের প্রতি ধনীদের দয়ার ভিক্ষা। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে যাকাত হলো যাকাতদাতাদের উপর ধার্য করা এক প্রকার বাধ্যতামূলক ট্যাক্স এবং দরিদ্রদের জন্য এটা হক বা অধিকার । পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

অর্থ: “আর তাদের (ধনীদের) মালের মধ্যে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার ।

ইসলামী সরকার যাকাত উসূল করে যথানিয়মে বিলি বন্টনের ব্যবস্থা করলে যাকাতের যথাযোগ্য হকদার ব্যক্তিরা তা অত্যন্ত সম্মানের সাথে পেতে পারে। বর্তমানে যারা যাকাত পায় তারা অপমানজনকভাবেই দাতাদের অনুগ্রহ হিসেবে তা পাচ্ছে । 

ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তির এখানে যে দুর্দশা তা থেকেই অনুমান করা যায় যে, গোটা ইসলামী জীবন বিধানের মর্যাদা এখানে কতটুকু? ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী সবার অন্তরে দ্বীনে হকের যত উচ্চ মর্যাদাই থাকুক, বাস্তবে এ দেশে যে দ্বীনে বাতিলের অধীনে ইসলামের নামটুকু মাত্র বেঁচে আছে, তা ইসলাম দরদীরাই উপলব্ধি করতে সক্ষম। যেটুকু ইসলাম বেঁচে আছে তা দ্বীনি মাদরাসাগুলোরই বিশেষ অবদান । এসব মাদরাসা না থাকলে কুরআন ও হাদীসের কোন চর্চাই থাকতো না । মুসলিম জনগণের সাহায্য না হলে এসব মাদরাসার অস্তিত্বই অসম্ভব হতো । বাতিলের অধীনে এটুকু বেঁচে থাকাটাও বড় সৌভাগ্যের কথা ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঈমান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

শবে বরাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

বিদআত থেকে সাবধান হতে করনীয়