দ্বীন কায়েমের বাস্তব উদাহরণ কি?

 

দ্বীন কায়েমের বাস্তব উদাহরণ কি?

  

দ্বীন কায়েমের বাস্তব উদাহরণ কি? 

উত্তর: এ পর্যায়ে আমাদের সামনে দুটি প্রশ্ন দেখা দেয়। একটি হলো দ্বীন কায়েম করার অর্থ কি? অপরটি হলো 'দ্বীন' অর্থ কি যা কায়েম করার এবং কায়েম রাখার আদেশ করা হয়েছে? এ দুটি বিষয় ভলোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার । ‘কায়েম করা' কথাটি যখন কোন বস্তুগত বা দেহধারী জিনিসের জন্য ব্যবহৃত হয় তখন তার অর্থ হয় উপবিষ্টকে উঠানো, যেমন: কোন মানুষ বা জন্তুকে উঠানো। কিংবা পড়ে থাকা জিনিসকে উঠিয়ে দাঁড় করানো।

যেমন: বাঁশ বা কোন থাম তুলে দাঁড় করানো। অথবা কোন জিনিসের বিক্ষিপ্ত অংশ গুলোকে একত্রিত করে সমুন্নত করা। যেমন কোন খালি জায়গায় বিল্ডিং নির্মাণ করা। কিন্তু যা বস্তুগত বা দেহধারী জিনিস নয় বরং অবস্তুগত বা দেহহীন জিনিষ তার জন্য যখন কায়েম করা শব্দটি ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ শুধু সেই জিনিসের প্রচার করাই নয়, বরং তা যথাযথভাবে কার্যে পরিণত করা, তার প্রচলন ঘটানো এবং কার্যত প্রতিষ্ঠা করা । উদাহরণ স্বরূপ যখন আমরা বলি, অমুক ব্যক্তি তার রাজত্ব কায়েম করেছে তখন তার অর্থ এই হয় না যে, সে তার রাজত্বের দিকে আহবান জানিয়েছে। বরং তার অর্থ হয়, সে দেশের লোকদেরকে নিজের অনুগত করে নিয়েছে এবং সরকারের সকল বিভাগে এমন সংগঠন ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করেছে যে, দেশের সমস্ত ব্যবস্থাপনা তার নির্দেশ অনুসারে চলতে শুরু করেছে। অনুরূপ যখন আমরা বলি, দেশে আদালত কায়েম আছে তখন তার অর্থ হয়: ইনসাফ করার জন্য বিচারক নিয়োজিত আছেন। তিনি মোকাদ্দমা সমূহের শুনানি করছেন এবং ফয়সালা দিচ্ছেন। একথার এ অর্থ কখনো হয় না যে, ন্যায়বিচার ও ইনসাফের গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা খুব ভালভাবে করা হচ্ছে এবং মানুষ তা সমর্থন করছে ।

অনুরূপভাবে কুরআন মজিদে যখন নির্দেশ দেয়া হয়, সালাত কায়েম করো তখন তার অর্থ সালাতের দাওয়াত ও তাবলীগ নয় বরং তার অর্থ হয় সালাতের সমস্ত শর্তাবলী পূরণ করে শুধু নিজে আদায় করা না বরং এমন ব্যবস্থা করা যেন ঈমানদারদের মধ্যে তা নিয়মিত প্রচলিত হয়। মসজিদের ব্যবস্থা থাকে, গুরুত্বের সাথে জুমআ' ও জামাআ'তের ব্যবস্থা হয়, সময়মত আযান দেয়া হয়, ইমাম ও খতীব নির্দিষ্ট থাকে এবং মানুষের মধ্যে সময়মত মসজিদে আসা ও সালাত আদায় করার অভ্যাস সৃষ্টি হয় । এই ব্যাখ্যার পরে একথা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, নবী-রাসূলুল্লাহ (আ:) দের যখন এই দ্বীন কায়েম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো, তখন তার অর্থ শুধু এতটুকু ছিল না যে, তারা নিজেরাই কেবল এ দ্বীনের বিধান মেনে চলবেন, অন্যদের কাছে তার তাবলীগ বা প্রচার করবেন, যাতে মানুষ তার সত্যতা মেনে নেয় বরং তার অর্থ এটাও যে, মানুষ যখন তা মেনে নেবে তখন তারা আরো অগ্রসর হয়ে তাদের মাঝে পুরো দ্বীনের  প্রচলন ঘটাবেন, যাতে সে অনুসারে কাজ আরম্ভ হতে এবং চলতে থাকে । এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে দাওয়াত ও তাবলীগ এ কাজের অতি আবশ্যিক প্রাথমিক স্তর। এই স্তর ছাড়া দ্বিতীয় স্তর আসতেই পারে না। কিন্তু প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন এই নির্দেশের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য করা হয়নি, দ্বীনকে কায়েম করা ও কায়েম রাখাকেই 'উদ্দেশ্য' বানানো হয়েছে। দাওয়াত ও তাবলীগ অবশ্যই এ উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নয় । সুতরাং নবী-রাসূলুল্লাহদের মিশনের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো ‘দাওয়াত ও তাবলীগ করা' একথা বলা একেরারেই অবান্তর । এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন টি দেখুন। কেউ কেউ বলেন: পবিত্র কুরআনে যে দ্বীন কায়েম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা ঐ একই দ্বীন পূর্বের সমস্ত নবী রাসূলদেরকেও সমান ভাবে কায়েম করতে বলা হয়েছে। যদিও তাদের সবার শরীয়াতের শাখা-প্রশাখাগত আমল ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যেমন আল্লাহ কুরআন মজিদে বলেছেন:

অর্থ: “আমি তোমাদের প্রত্যেক উম্মতের জন্যে স্বতন্ত্র শরীয়াত এবং স্বতন্ত্র পদ্ধতি নির্ধারিত করে দিয়েছি । 

তাই তারা ধরে নিয়েছে যে, এ দ্বীন অর্থ নিশ্চয়ই শরীয়াতের আদেশ নিষেধ ও বিধি-বিধান নয়, বরং এর অর্থ শুধু তাওহীদ, আখেরাত, কিতাব, ও নবুওয়াতকে মানা এবং আল্লাহর ইবাদত করা। তারা নিম্নের মুফাসসিরগণের মতামতকে দলীল-প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন:

ইমাম হাসান বিন মুহাম্মদ নিশাপুরী (র:) বলেন:

هو اقامة الدين يعني اقامة أصوله من التوحيد والثبوة والمعاد ونحو ذلـك ذون الفروع التي تختلف بحسب الأوقات لقوله { لكل جعلنا منكم شرعة ومنهاجاً }

(সূরা মায়েদা: ৫ঃ৪৮)

অর্থ: “দ্বীনের উছূল বা মূলনীতি সমূহ প্রতিষ্ঠিত কর। যেমন: তাওহীদ, নবুওয়াত, আখেরাতের উপর বিশ্বাস বা অনুরূপ বিষয় সমূহ। শাখা-প্রশাখা বিষয় সমূহ নয়, যা সময়ভেদে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন. তোমাদের জন্য আমরা পৃথক পৃথক বিধি-বিধান ও পদ্ধতি সমূহ নির্ধারিত করেছি ।”৪১

ইমাম কুরতুবী (র:) বলেছেন: 

" أن أقيموا الدين " وهو توحيد الله وطاعته، والايمان برسله وكتبه وبيوم الجزاء، وبسائر ما يكون الرجل بإقامته مسلما.ولم يرد الشرائع التي هي مصالح الـامم

على حسب أحوالها، فإنها مختلفة متفاوتة 

অর্থ: “দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর” এর অর্থ হল, আল্লাহর তাওহীদ ও তাঁর আনুগত্য, তাঁর রাসূলগণের উপরে, কিতাব সমূহের উপরে, কিয়ামত দিবসের উপরে এবং একজন মানুষকে মুসলিম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেসব বিষয় প্রয়োজন সবকিছুর উপরে ঈমান আনয়ন কর। অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন উম্মতের উপরে যেসকল শরীয়ত বা ব্যবহারিক বিধি-বিধান নির্ধারিত হয়েছে, সেগুলো এই আয়াতের বিষয় বস্তুর অন্তর্ভূক্ত নয় । "৪২ বায়যাভী (রঃ) বলেন:

البدل وهو الإيمان بما يجب تصديقة والطاعة في أحكام الله ومحله النصب - على

من مفعول

অর্থ: “দ্বীন অর্থ যেসবের উপরে ইয়াকীন রাখা ওয়াজিব, সেসবের উপরে ঈমান আনা এবং আল্লাহর বিধান সমূহের আনুগত্য করা ।”৪৩ হাফেজ ইবনে কাছীর বলেন:

والدين الذي جاءت به الرسل كلهم هو عبادة الله وحده لا شريك له كما قال عز وجل: {وما أرسلنا من قبلك من رسول إلا نوحي إليه أنه لا إله إلا أنا فاعبدون}.

وفي الحديث «نحن معشر الأنبياء أولاد علات ديننا واحد» أي القدر المـشترك

الله وحده لا شريك له وإن اختلفت شرائعهم ومناهجهم

بينهم هو عبادة

অর্থ: “ঐ দ্বীন যা নিয়ে সকল রাসূলগণ আগমন করেছিলেন, তা হল এক

আল্লাহর ইবাদত করা, যার কোন শরীক নেই। যেমন আল্লাহ

(সুব:)ইরশাদ করেন: আর তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল আমি পাঠাইনি

যার প্রতি আমি এই ওহী নাযিল করিনি যে, 'আমি ছাড়া কোন (সত্য)

ইলাহ নেই; সুতরাং তোমরা আমার ইবাদাত কর।' রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু

আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: 'আমরা নবীর দল সকলেই আল্লাতি ভাই

এবং সকলের দ্বীন অভিন্ন । অর্থাৎ মৌলিক বিষয়ের বিবেচনায় সকলের দ্বীন

এক,

যদিও তাদের শরীআ'ত ও কর্মধারা পৃথক ছিল ।"৪৪

ইমাম জালালুদ্দীন মাহাল্লী বলেন:

أن أقيموا الدين ولا تتفرقوا فيه .....هو التوحيد

অর্থ: “তোমরা দ্বীন কায়েম কর এবং এ ব্যাপারে পরষ্পরে বিছিন্ন হয়ো এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন । অর্থ ‘সেটা (দ্বীন অর্থ) হলো তাওহীদ' j″৪৫

ইমাম শাওকানী বলেন:

أن أقيموا الدين ( أي توحيد الله والإيمان به وطاعة رسله وقبول شرائعه 

অর্থ: “ইক্বামাতে দ্বীনের অর্থ হলো আল্লাহর তাওহীদ ও তাঁর উপরে ঈমান আনা, তাঁর রাসূলগণের উপরে ঈমান আনা ও আল্লাহর শরী'আত সমূহ কবুল করা ।″৪৬

আব্দুর রহমান বিন নাছের সা'দী বলেন:

أقيموا الدين } أي: أمركم أن تقيموا جميع شرائع الدين أصوله وفروعه،

 { أن

৪৪ তাফসীরে ইবনে কাসীর সুরা শুরা ১৩ নং আয়াতের তাফসীরে দ্রষ্টব্য। ৪º তাফসীরে জালালাইন ১ম খন্ড, ৬৩৯ পৃষ্ঠায় সুরা শুরার ১৩ নং আয়াতের তাফসীরে দ্রষ্টব্য । ৪৬ তাফসীরে ফাতহুল কাদীর ৪ খন্ড, ৫৩০ নং পৃষ্ঠা, সুরা শুরার ১৩ নং আয়াতের তাফসীরে দ্রষ্টব্য।

تقيمونة بأنفسكم، وتجتهدون في إقامته على غيركم، وتعـاونون علـى البـر والتقوى ولا تعاونون على الإثم والعدوان. { ولا تتفرقوا فيه }

অর্থ: “আমি তোমাদের আদেশ করছি যে, তোমরা দ্বীনের মৌলিক ও শাখা-প্রশাখা সমূহ সহকারে সকল বিধি-বিধান নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা কর এবং অপরের মধ্যে তা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা কর। নেকী ও তাক্বওয়ার কাজে পরষ্পরকে সাহায্য কর। অন্যায় ও গোনাহের ব্যাপারে কাউকে সাহায্য করো না এবং তা করতে গিয়ে পরস্পরে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ো

তারা উপরোক্ত তাফসীরসমূহের ভিত্তিতে শুধু তাওহীদ, আখেরাত, কিতাব, ও নবুওয়াতকে মানা এবং আল্লাহর ইবাদত করাকেই ‘ইক্বামাতে দ্বীন' বা দ্বীন কায়েম করা বলতে চান। শরীয়াতের আদেশ-নিষেধ ও বিধি বিধান কায়েম করা নয়। কিন্তু এটি একটি অপরিপক্ক মত। কেননা উপরোক্ত তাফসীরকারকদের উদ্দেশ্য তা নয়। বরং তাদের কথার সারমর্ম হলো “ইকামাতে দ্বীন অর্থ ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে ও আন্তর্জাতিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাওহীদ বা এক আল্লাহর ইবাদত প্রতিষ্ঠা করা ।”

তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে আলাদা করার কোন সুযোগ নেই। যারা তাওহীদ বলতে শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা করাকে বুঝান এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন-কানুন ও বিধি বিধান তৈরী করাকে শিরক মনে করেন না তারা তাদের ভুল চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা করার জন্য উপরোক্ত তাফসীর সমূহ দলীল-প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করার ব্যর্থ চেষ্ট করে থাকেন।

কিন্তু এটি মারাত্মক ভুল। কেননা তারা শুধু বহ্যিকভাবে সকল নবীদের দ্বীনের মৌলিক ঐক্য ও শরীয়তের শাখাগত আমলসমূহের বিভিন্নতা দেখে এ মত পোষণ করেছেন। এটি এমন একটি বিপজ্জনক মত যে, যদি তা সংশোধন করা না হয় তাহলে তা অগ্রসর হয়ে দ্বীন ও শরীয়তের মধ্যে এমন একটি পার্থক্যের সূচনা করবে যার মধ্যে জড়িয়ে সেন্ট পল শরীয়ত  বিহীন দ্বীনের মতবাদ পেশ করেছিলেন এবং ঈসা (আ:) এর উম্মতকে ধ্বংস ও বিপর্যস্ত করেছিলেন। কারণ, শরীয়ত যখন দ্বীন থেকে সতন্ত্র একটি জিনিস আর নির্দেশ দেয়া হয়েছে শুধু দ্বীন কায়েমের জন্য শরীয়ত কায়েমের জন্য নয়। তখন মুসলমানরাও খৃস্টানদের মত অবশ্যই শরীয়তকে গুরুত্বহীন ও তার প্রতিষ্ঠাকে সরাসরি উদ্দেশ্য মনে না করে উপেক্ষা করবে এবং দ্বীনের মধ্যথেকে শুধু ঈমান সম্পর্কিত বিষয়গুলো ও বড় বড় নৈতিক নীতিসমূহ নিয়েই বসে থাকবে। যেমনটা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, অনেকেই বলে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখতে হবে। যেটা বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি নামে প্রসিদ্ধ ।

কাজেই এভাবে অনুমানের ওপর নির্ভর করে ১১ এর অর্থ নিরূপন করার পরিবর্তে কেনই বা আমরা আল্লাহর কিতাব থেকে জেনে নিচ্ছি না যে, 'দ্বীন কায়েম' করার নির্দেশ যেখানে দান করা হয়েছে সেখানে তার অর্থ কি শুধু ঈমান সম্পর্কিত বিষয়সমূহ এবং কতিপয় বড় বড় নৈতিক মূলনীতি, না শরীয়তের অন্যান্য আদেশ নিষেধও অন্তর্ভুক্ত? কুরআন মাজীদ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি কুরআন মজীদে যেসব জিনিসকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে নিম্নোক্ত জিনিসগুলোও আছে। এক:

وما أمروا إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين حنفاء ويقيموا الصلاة ويؤتوا الزكـاة

অর্থ: “আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত' করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হল সঠিক দ্বীন  এ আয়াত থেকে জানা যায়, সালাত এবং সাওম এই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। অথচ সালাত ও সাওমের আহকাম বিভিন্ন শরিয়াতে বিভিন্ন রকম ছিল ৷ পূর্ববর্তী শরীয়াতসমূহে বর্তমানের মত সালাতের এই একই নিয়ম-কানুন, একই খুঁটি-নাটি বিষয়, একই সমান রাকআত, একই কিবলা, একই সময় এবং এই একই বিধি বিধান ছিল একথা কেউ বলতে পারে না। অনুরূপ যাকাত সম্পর্কে কেউ এ দাবী করতে পারে না যে, সমস্ত শরীয়তে  বর্তমানের ন্যায় যাকাতের এই একই নিসাব, একই হার এবং আদায় ও বন্টনের এই একই বিধিনিষেধ ছিল। কিন্তু শরীয়তের ভিন্নতা সত্তেও আল্লাহ এ দুটি জিনিসকে দ্বীনের মধ্যে গণ্য করেছন ।

দুই : حرمت عليكم الميتة والدم ولحم الخنزير وما أهل لغير اللـه بـه والمنخقـة والموقودة والمتردية والنطيحة وما أكل السبع إلا ما ذكيتم وما ذبح على النصب وأن تستقسموا بالأزلام ذلكم فسق اليوم ينس الذين كفروا مـن ديـكـم ف تخشوهم واخشون اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعمتي ورضـيت

لكم الإسلام دينا [المائدة/3] 


অর্থ: “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত ও শূকরের গোশত এবং যা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো নামে যবেহ করা হয়েছে; গলা চিপে মারা জন্তু, প্রহারে মরা জন্তু, উঁচু থেকে পড়ে মরা জন্তু, অন্য প্রাণীর শিঙের আঘাতে মরা জন্তু এবং যে জন্তুকে হিংস্র প্রাণী খেয়েছে-তবে যা তোমরা যবেহ করে নিয়েছ (মারা যাওয়ার আগেই) তা ছাড়া, আর যা মূর্তি পূজার বেদিতে বলি দেয়া হয়েছে এবং জুয়ার তীর দ্বারা বণ্টন করা হয়, এগুলো গুনাহ। যারা কুফরী করেছে, আজ তারা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, বরং আমাকে ভয় কর । আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে এ থেকে জানা গেল যে, শরীয়তের এসব হুকুম আহকামও দ্বীনের মধ্যে শামিল।

তিন।

قاتلوا الذين لا يؤمنون بالله ولا باليوم الآخر ولا يحرمون ما حرم الله ورسوله ولا

يدينون دين الحق [التوبة/٢٩] 

অর্থ: “তোমরা যুদ্ধ কর আহলে কিতাবের সে সব লোকের সাথে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না, আর সত্য দ্বীন গ্রহণ করে

এ থেকে জানা যায়, আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করা এবং আল্লাহ ও তার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব আদেশ নিষেধ দিয়েছেন তা মানা ও তার আনুগত্য করাও দ্বীন।

চার:

الزانية والزاني فاجلدوا كل واحد منهما مائة جلدة ولا تأخذكم بهما رأفة في دين

الله إن كنتم تؤمنون بالله واليوم الآخر وليشهد عذابهما طائفة من المؤمنين.

 অর্থ: “ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশ'টি করে বেত্রাঘাত কর। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান এনে থাক তবে আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে পেয়ে না বসে ।"৫১

এ চারটি উদাহরণই এমন যেখানে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ ও বিধি বিধানকে সুস্পষ্ট ভাষায় দ্বীন বলা হয়েছে । কিন্তু গভীর মনোযোগ সহকারে দেখলে বুঝা যায়, আরও যেসব গুনাহের কারণে আল্লাহ জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন (যেমন ব্যভিচার, সুদখোরী, মুমিন বান্দাকে হত্যা, ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ, অন্যায়ভাবে মানুষের অর্থ নেয়া ইত্যাদি) এবং যেসব অপরাধকে আল্লাহর শাস্তির কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে (যেমনঃ লুতের কওমের মত পাপাচার এবং পারস্পারিক লেনদেনে শুয়াইব (আ:) এর কওমের মত আচরণ) তার পথ রুদ্ধ করার কাজেও অবশ্যই দ্বীন হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। কারণ, দ্বীন যদি জাহান্নাম ও আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করার জন্য না এসে থাকে তাহলে আর কিসের জন্য এসেছে। অনুরূপ শরীয়তের যেসব আদেশ-নিষেধ লংঘনকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের  কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে সেই সব আদেশ-নিষেধও দ্বীনের অংশ হওয়া উচিত। যেমন উত্তরাধিকার বিধি-বিধান বর্ণনা করার পর বলা হয়েছেঃ

ورسوله ويتعد حدوده يدخله نارا خالدا فيها وله عذاب مهين. ومن يعص ا 

অর্থ: “আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক আযাব ।"৫২ অনুরূপ আল্লাহ যেসব জিনিসের হারাম হওয়ার কথা কঠোর ভাষায় অকাট্যভাবে বর্ণনা করেছেন, যেমনঃ মা, বোন ও মেয়ের সাথে বিয়ে, মদ্যপান, চুরি, জুয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দান। এসব জিনিসের হারাম হওয়ার নির্দেশকে যদি “ইকামাতে দ্বীন” বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার মধ্যে গণ্য করা না হয় তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ কিছু অপ্রয়োজনীয় আদেশ নিষেধও দিয়েছেন যার বাস্তবায়ন তার উদ্দেশ্য নয় । অনুরূপ আল্লাহ যেসব কাজ ফরজ করেছেন, যেমন: সাওম ও হজ্জ তাও দ্বীন প্রতিষ্ঠার পর্যায় থেকে এই অজুহাতে বাদ দেওয়া যায় না যে, রমজান মাসে ত্রিশটি সাওম পূর্ববর্তী শরীয়াত সমূহে ছিল না এবং কাবায় হজ্জ করা কেবল সেই শরীয়তেই ছিল যা ইবরাহীমের (আ:) বংশধারার ইসমাঈলী শাখাকে দেয়া হয়েছিল । প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ভূল বোঝাবোঝি সৃষ্টির কারণ হলো,

অর্থ: “তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীআত ও স্পষ্ট পন্থা |”৫৩

আয়াতের এ অর্থ করা যে, যেহেতু প্রত্যেক উম্মতের জন্য শরীয়াত ছিল ভিন্ন কিন্তু কায়েম করতে বলা হয়েছে দ্বীনকে যা সমানভাবে সব নবী রাসূলদের দ্বীন ছিল, তাই দ্বীন কায়েমের নির্দেশের মধ্যে শরীয়ত অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ এ আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সূরা মায়েদার যে স্থানে এ আয়াতটি আছে তার পূর্বাপর অর্থাৎ ৪১নং আয়াত থেকে ৫০নং আয়াত পর্যন্ত যদি কেউ মনযোগ সহকারে পাঠ করে তাহলে  সে জানতে পারবে আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে “আল্লাহ যে নবীর উম্মতকে যে শরীয়ত দিয়েছিলেন সেটিই ছিল তাদের জন্য দ্বীন এবং সেই নবীর নবৄওয়াতকালে সেই দ্বীন কায়েম করাই কাম্য ও উদ্দেশ্য ছিল ।

এখন যেহেতু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াতের যুগ সেহেতু উম্মতে মুহাম্মদীকে যে শরীয়াত দান করা হয়েছে এ যুগের জন্য সেটিই দ্বীন এবং সেটিকে প্রতিষ্ঠা করাই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করা। এরপর থাকে শরীয়াতের পরস্পর ভিন্নতা। এ ভিন্নতার তাৎপর্য এই নয় যে, আল্লাহর দ্বীন অর্থাৎ শরীয়াত সমূহ পরস্পর বিরোধী ছিল । সঠিক তাৎপর্য হলো অবস্থা, পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ঐ সব শরীয়তে কিবলা এক ছিল না। তাছাড়া সালাতের সময়, রাকাআতের সংখ্যা এবং বিভিন্ন অংশে কিছুটা পার্থক্য ছিল। অনুরূপ সাওম সব শরীয়তেই ফরয ছিল । কিন্তু রমাযানের ত্রিশটি সাওম অন্যান্য শরীয়তে ছিল না। এ থেকে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঠিক নয় যে, সালাত ও সাওম “ইকামাতে দ্বীন” তথা দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ঠিকই কিন্তু নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সালাত আদায় করা এবং নির্দিষ্ট কোন সময়ে সাওম রাখা ‘ইকামাতে দ্বীনের' বহির্ভুত । বরং এর সঠিক অর্থ হলো, প্রত্যেক নবীর উম্মতের জন্য তৎকালীন শরীয়তে সালাত ও সাওম আদায়ের জন্য যে নিয়ম-পদ্ধতি ঠিক করা হয়েছিল সেই সময়ে সেই পদ্ধতি অনুসারে সালাত কায়েম করা ও সাওম পালন করাই ছিল দ্বীন কায়েম করা। বর্তমানে এসব ইবাদতের জন্য শরীয়াতে মুহাম্মদীতে যে নিয়ম-পদ্ধতি দেয়া হয়েছে সে মোতাবেক ইবাদাত-বন্দেগী করাই “ইকামাতে দ্বীন”। এ দুটি দৃষ্টাত্তের ভিত্তিতে শরীয়াতের অন্যান্য সব আদেশ-নিষেধও বিচার করুন ।

যে ব্যক্তি চোখ খুলে কুরআন মাজীদ পড়বে সে স্পষ্ট দেখতে পাবে যে, এই গ্রন্থ তার অনুসারিদেরকে কুফরি ও কাফেরদের আজ্ঞাধীন ধরে নিয়ে বিজিতের অবস্থানে থেকে ধর্মীয় জীবন যাপন করার কর্মসূচী দিচ্ছে না বরং প্রকাশ্যে নিজের শাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে । চিত্তাগত, নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আইনগত ও রাজনৈতিক ভাবে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জীবনাপাত করার জন্য অনুসারীদের কাছে দাবী করছে এবং তাদেরকে  মানবজীবনের সংস্কার ও সংশোধনের এমন একটি কর্মসূচী দিচ্ছে যার একটি বৃহদাংশ কেবল তখনই বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ঈমানদারদের হাতে থাকে ।

আল্লাহ (সুব:) কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেন ঃ 

إنا أنزلنا إليك الكتاب بالحق لتحكم بين الناس بما أراك الله. 

অর্থ: “নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি যথাযথভাবে কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে ফয়সালা কর সে অনুযায়ী যা আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছেন । ৫৪

এই কিতাবে যাকাত আদায় ও বন্টনের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে এমন একটি সরকারের ধারণা পেশ করেছে, যে সরকার একটি নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে যাকাত আদায় করে হকদারদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে । আল্লাহ তায়ালা বলেন: 

إنما الصدقات للفقراء والمساكين والعاملين عليها والمؤلفة قلوبهم وفي الرقاب

والغارمين وفي سبيل الله وابن السبيل فريضة من الله والله عليم حكيم. 

অর্থ: নিশ্চয় সাদাকা হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় (যুদ্ধে) এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময় । “

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে:

خذ من أموالهم صدقة تطهرهم وتزكيهم بها وصل عليهم إن صلاتك سكن لهم


অর্থ: “তাদের সম্পদ থেকে সাদাকা নাও । এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্য দো'আ কর, নিশ্চয় তোমার দো'আ তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ ।”৫৬

এই কিতাবে সুদ বন্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে এবং সুদখোরী চালু রাখার কাজে তৎপর লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে । ইরশাদ

{الذين يأكلون الربا لا يقومون إلا كما يقوم الذي يتخبطه الشيطان مـن المـس ذلك بأنهم قالوا إنما البيع مثل الربا وأحل الله البيع وحرم الربـا فـمـن جـاءه موعظة من ربه فائتهى فله ما سلف وأمره إلى الله ومن عاد فأولئك أصحاب الثار لهم فيها خالدون (٢٧٥) يمحق الله الربا ويربي الصدقات والله لا يحب كل كفار أثيم (٢٧٦) إن الذين آمنوا وعملوا الصالحات وأقـامـوا الـصلاة وآتـوا ولا هم يحزنون (۲۷۷) يا أيهـا كنتم مؤمنين (۲۷۸) فـان لـم م فلكم رءوس أموالكم لا تظلمـون عند ربهم ولا خوف . الزكاة لهم أجره الذين آمنوا اتقوا الله وذروا ما بقي من ا تفعلوا فأذنوا بحرب ولا تظلمون (٢٧۹) وإن كان ذو عسرة فنظرة إلى ميسرة وأن تصدقوا خير لكم إن كنتم تعلمون (٢٨٠) واتقوا يوما ترجعون فيه إلى الله ثم توفى كل نفس مـا كسبت وهم لا يظلمون} [البقرة : ٢٧٥ – ۲۸۱]

অর্থ: “যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই । অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন । অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, তবে যা পিছনে হয়েছে তা তাঁর জন্যই। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা পুনরায় ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে। আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন  এবং সাদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না। নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে এবং সালাত কায়েম করে, আর যাকাত প্রদান করে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট প্রতিদান। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। এই হুকুম কেবল তখনই বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকবে ঈমানদারদের হাতে ।

এই কিতাবে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকারীর থেকে কিসাস গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ (সুব:) বলেন:

 {يا أيها الذين آمنوا كتب عليكم القصاص في القتلى الحر بالحر والعبد بالعبـد

والأنثى بالأنثى فمن عفي له من أخيه شيء فاتباع بالمعروف وأداء إليه بإخـسان ذلك تخفيف من ربكم ورحمة فمن اعتدى بعد ذلك فله عذاب أليم} 

অর্থ: “হে মুমিনগণ, নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের উপর 'কিসাস’ ফরয করা হয়েছে। স্বাধীনের বদলে স্বাধীন, দাসের বদলে দাস, নারীর বদলে নারী । তবে যাকে কিছুটা ক্ষমা করা হবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে, তাহলে সততার অনুসরণ করবে এবং সুন্দরভাবে তাকে আদায় করে দেবে। এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে হালকাকরণ ও রহমত। সুতরাং এরপর যে সীমালঙ্ঘন করবে, তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব ।”৫৭

এই কিতাবে চুরির ব্যাপারে হাত কাটার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ (সুব:)ইরশাদ করছেন

: الله والله عزيـز من والسارق والسارقة فاقطعوا أيديهما  جزاء بما كسبا نكالا

{ অর্থ: “আর পুরুষ চোর ও নারী চোর তাদের  উভয়ের হাত কেটে দাও তারা যা করেছে তার প্রতিদান স্বরূপ ও আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষণীয় আযাবস্বরূপ এবং আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। এই কিতাবে ব্যাভিচারের শাস্তির ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ (সুব:) ইরশাদ করছেন:

الزانية والزاني فاجلدوا كل واحد منهما مائة جلدة ولا تأخذكم بهما رأفة فـي الله إن كنتم تؤمنون بالله واليوم الآخر وليشهد عذابهما طائفة من المؤمنين.

دین অর্থ: "ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশ'টি করে বেত্রাঘাত কর। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান এনে থাক তবে আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে পেয়ে না বসে। আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের আযাব প্রত্যক্ষ করে।”

  কুরআন মাজিদে  এসব সুস্পষ্ট আদেশ বর্ণনা     হয়েছে।  যেগুলো অমান্যকারীদের পুলিশ ও আদালতের অধীনে থাকতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। এই কিতাবে আল্লাহ (সুব:) কাফেরদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ

দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:

وقاتلوا في سبيل الله الذين يقاتلونكم ولا تعتدوا إن الله لا يحب المعتدين

অর্থ: “আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তাদের (কাফেরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”৬০ অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:

{كتب عليكم القتال وهو كرة لكم وعسى أن تكرهوا شيئا وهـو خـيـر لكـم

أن تحبوا شيئا وهو شر لكم والله يعلم وأنتم لا تعلمون}

 অর্থ: “তোমাদের উপর (কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

 করাকে ফরজ করে وعسى أ দেওয়া হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর প্রকৃত বিষয়) আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। ৬১


এখানে বলা হয়নি যে, যারা দ্বীন মেনে চলে তারা কাফিরদের সরকারী বাহিনীতে সৈন্য ভর্তি করে এ নির্দেশ পালন করবে। বরং এজন্য মুমিনদের নিজেদেরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে । এমনিভাবে এই কিতাবে আল্লাহ (সুব:) আহলে কিতাবিদের কাছ থেকে

জিযিয়া কর নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:

 قاتلوا الذين لا يؤمنون بالله ولا باليوم الآخر ولا يحرمون ما حرم الله ورسـوله ولا يدينون دين الحق من الذين أوتوا الكتاب حتى يعطوا الجزية عن يـد وهـم

অর্থ: “তোমরা যুদ্ধ কর আহলে কিতাবের সে সব লোকের সাথে যারা

আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা

হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না, আর সত্য দ্বীন গ্রহণ করে না,

যতক্ষণ না তারা স্বহস্তে নত হয়ে জিয়া দেয় । "৬২ একথা বলা হয়নি যে মুসলমানরা কাফেরদের অধীন থেকে তাদের জিযিয়া আদায় করবে এবং তাদের রক্ষার দায়িত্ব নেবে। এ ব্যপারটি শুধু মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমুহ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বোধ সম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাবেন মক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর মধ্যে প্রথম থেকেই যে পরিকল্পনা ছিল তা হলো দ্বীনের বিজয় ও কর্তৃত্ব স্থাপন, কুফরি সরকারের অধীনে দ্বীন ও দ্বীনের অনুসারীদের জিম্মি হয়ে থাকা নয় ।

তাদের ব্যাখ্যার এই ভ্রান্তি যে জিনিষটির সাথে সবচেয়ে বেশী সাংঘর্ষিক তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিজের বিরাট কাজ। যা তিনি ২৩ বছরের রিসালাতের যুগে সমাধা করেছেন। তিনি তাবলীগ তলোয়ার উভয়টির সাহায্যেই গোটা আরবকে বশীভূত করেছেন এবং বিস্তারিত শরীয়াত বা বিধি-বিধানসহ এমন একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় আদর্শ কায়েম করেছিলেন যা আক্কীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কর্মকান্ড, সামাজিক চরিত্র, সভ্যতা ও সংস্কৃতি অর্থনীতি ও সমাজনীতি, রাজনীতি ও ন্যায় বিচার এবং যুদ্ধ ও সন্ধিসহ জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগে পরিব্যপ্ত ছিল ।

এ আয়াত অনুসারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সমস্ত নবী রাসূলুল্লাহকে ইকামাতে দ্বীনের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এসব কাজকে যদি তার বলে গ্রহণ করা না হয় তাহলে তার কেবল দুটি অর্থই হতে পারে। হয়তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরোপ করতে হবে (মাআ'যাল্লাহ) যে, তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন শুধু ঈমান ও নৈতিক চরিত্র সম্পর্কিত বড় বড় মূলনীতি সমূহের তাবলীগ ও দাওয়াতের জন্য কিন্তু তা লংঘন করে তিনি নিজের পক্ষ থেকেই একটি সরকার কায়েম করেছিলেন, যা অন্যসব নবী-রাসূলদের শরীয়াত সমূহের সাধারণ নীতিমালা থেকে ভিন্ন ছিল, অতিরিক্তও ছিল । নয়তো আল্লাহর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরোপ করতে হবে যে, তিনি সূরা শুরায় উপরোক্ত ঘোষণা দেওয়ার পর নিজেই তার কথা থেকে সরে পড়েছিলেন এবং নিজের নবীর নিকট থেকে ঐ সূরায় ঘোষিত ইক্কামাতে দ্বীনের চেয়ে কিছুটা বেশী এবং ভিন্ন ধরনের কাজই শুধু নেননি, বরং উক্ত কাজকে পূর্ণতা লাভের পর নিজের প্রথম ঘোষণার পরিপন্থি ২য় এই ঘোষনাটিও দিয়েছেন যে,

اليوم أكملت لكم دينكم

অর্থ: “আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণতা দান করলাম ।”৬৩ নাউযুবিল্লাহ! এ দুটি অবস্থা ছাড়া ৩য় এমন কোন অবস্থা যদি থাকে যে ক্ষেত্রে ইকামাতে দ্বীন এর ব্যাখ্যাও বহাল থাকে এবং আল্লাহ কিংবা তার রাসুলের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও না আসে তাহলে আমরা অবশ্যই তা জানতে চাইবো । 

দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়ার পর আল্লাহ এ আয়াতে সর্বশেষ যে কথা বলেছেন তা হচ্ছে:

অর্থ: “দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টি করোনা”৬৪ কিংবা তাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ো না । দ্বীনে বিভেদের অর্থ ব্যক্তির নিজের পক্ষ থেকে এমন অভিনব বিষয় সৃষ্টি করা এবং তা মানা বা না মানার উপর কুফর ও ঈমান নির্ভর করে বলে পীড়াপীড়ি করা এবং মান্যকারীদের নিয়ে অমান্যকারীদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া। অথচ দ্বীনের মধ্যে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই । এই অভিনব বিষয়টি কয়েক ধরণের হতে পারে। দ্বীনের মধ্যে যে জিনিস নেই তা এনে শামিল করা হতে পারে । দ্বীনের অকাট্য উক্তি সমূহের বিকৃত প্রায় ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে অদ্ভুত আকীদা-বিশ্বাস এবং অভিনব আচার অনুষ্ঠান আবিষ্কার করা হতে পারে। আবার দ্বীনের উক্তি ও বক্তব্য সমূহ রদবদল করে তা বিকৃত করা যেমন যা গুরুত্বপূর্ণ তাকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া এবং যা একেবারেই মোবাহ পর্যায়ভূক্ত তাকে ফরয ও ওয়াজিব এমনকি আরো অগ্রসর হয়ে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বানিয়ে দেওয়া । 

এ ধরণের আচরণের কারনেই নবী-রাসূলুল্লাহ (আ:) দের উম্মতদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর এসব ছোট ছোট দলের অনুসৃত পথই ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করেছে যার অনুসারীদের মধ্যে বর্তমানে এই ধারণাটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই যে এক সময় তাদের মূল ছিল একই । দ্বীনের আদেশ-নিষেধ বুঝার এবং অকাট্য উক্তি সমূহ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে মাসআলা উদ্ভাবন করার ক্ষেত্রে জ্ঞানী ও পন্ডিতদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর কিতাবের ভাষার মধ্যে আভিধানিক, বাগধারা ও ব্যকরণের নিয়ম অনুসারে যার অবকাশ আছে সেই বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত মতভেদের সাথে এই বিবাদের কোন সম্পর্ক নেই । হয়েছে ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঈমান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

শবে বরাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

বিদআত থেকে সাবধান হতে করনীয়