দ্বীন বলতে কি শুধু ধর্মীয় বিষয়কেই বুঝায় না ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোও এর অস্ত র্ভূক্ত?
প্রশ্ন: দ্বীন বলতে কি শুধু ধর্মীয় বিষয়কেই বুঝায় না ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোও এর অস্ত র্ভূক্ত?
উত্তর: আল্লাহর আনুগত্যের বিধান হিসেবে দ্বীন ইসলাম'কে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্যই উপযোগী করে তৈরী করা হয়েছে । ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সব বিষয়ে যাতে মানুষ একমাত্র আল্লাহর সঠিক আনুগত্য করতে পারে, সে উদ্দেশ্যেই আল্লাহ (সুব:) স্বয়ং ইসলামী জীবন বিধান রচনা করেছেন। সব দেশ, সব কাল ও সব জাতির উপযোগী জীবন বিধান রচনার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হতেই পারে না ।
আল্লাহর রচিত এ জীবন বিধানকে বাস্তব জীবনে কিভাবে পালন করা যায়, তার সত্যিকার নমুনা মানব জাতির নিকট পেশ করার জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ (সুব:) স্বয়ং এ ঘোষণা দিয়েছেন যে,
{لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة لمن كان يرجو الله واليـوم الـآخر
{ অর্থ: “অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। তাঁদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে। ২৩ অর্থাৎ মানুষ হিসেবে দুনিয়ায় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নমুনা হচ্ছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম । সুতরাং তাঁর প্রদর্শিত বিধানের মাধ্যমেই জীবন পরিচালনা করতে হবে।
যে দু'টি বিষয়ের সাক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে ইসলামে প্রবেশ করতে হয় সে দু'টি সাক্ষ্যের মর্মকথাও এই দাবী করে যে, আল্লাহর আদেশ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশের আনুগত্য সর্বব্যাপী। সাক্ষ্য দুটি হচ্ছে:
أشهد أن لا إله إلا الله، وأشهد أن محمداً عبده ورسوله
অর্থ: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।"
এ শব্দগুলো এমন কোন মন্ত্র নয় যে, তা উচ্চারণ করলেই আল্লাহর নিকট মুসলিম বলে গণ্য হয়ে যাবে। কালেমার অর্থ বুঝে কালেমার মর্মের প্রতি বিশ্বাস না করলে ঈমানের দাবী পূরণ হতে পারে না।
যেমন মনে করুন একজন লোক আদালতে হাজির হলো; বিচারক তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে? সে বলল, আমি এই খুনের মামলার একজন সাক্ষী।
বিচারক জিজ্ঞাসা করল, বল কে খুন করেছে? কাকে খুন করেছে?
লোকটি বলল, তা তো আমি জানিনা। তখন বিচারক কি বলবে? বিচারক বলবে যে, তুমি কি আদালতের সঙ্গে ফাজলামী করতে এসেছ? পুলিশ ডেকে লোকটিকে জেলে পাঠিয়ে দেবে ।
দুনিয়ার সামান্য আদালতে সাক্ষী দিতে হলে জেনে শুনে ও বুঝে সাক্ষী দিতে হয়। তাহলে সবচেয়ে বড় সাক্ষী এবং যে সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন, ফেরেস্তারা দিয়েছেন এবং সকল উলুল ইলমগণ (জ্ঞানীগণ) দিয়েছেন । সেই সাক্ষী কিভাবে না বুঝে, না জেনে দেওয়া যেতে পারে?
আল্লাহ, ফেরেশতা এবং সকল জ্ঞানীগণ এই দুটি বিষয়ের অর্থাৎ তাওহীদ এবং রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছেন এর প্রমাণ নিম্নের আয়াতটি:
{شهد الله أنه لا إله إلا هو والملائكة وأولو العلم قائما بالقسط لا إله إلا هو
العزيز الحكيم} [آل عمران : ۱۸]
অর্থ: “আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই, আর ফেরেশতা ও জ্ঞানীগণও (এই সাক্ষ্য দেন)। তিনি ন্যায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত । তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় ।”২৪ তাওহীদের সাক্ষ্য হচ্ছে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য এর প্রমাণ নিচের আয়াতটি:
{قل أي شيء أكبر شهادة قل الله شهيد بيني وبينكم وأوحي إلي هـذا القـرآن لأنذركم به ومن بلغ أنتكم لتشهدون أن مع الله آلهة أخرى قل لا أشهد قل إنما هو إله واحد وإنني بريء مما تشركون} [الأنعام : 19]
অর্থ: “বল, ‘সাক্ষ্য হিসেবে সবচেয়ে বড় কোন স্বাক্ষ্য?' বল, 'আল্লাহ সাক্ষী আমার ও তোমাদের মধ্যে। আর এ কুরআন আমার কাছে ওহী করে পাঠানো হয়েছে যেন তোমাদেরকে ও যার কাছে এটা পৌঁছবে তাদেরকে এর মাধ্যমে আমি সতর্ক করি। তোমরাই কি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে রয়েছে অন্যান্য উপাস্য? বল, 'আমি সাক্ষ্য দেই না'। বল, তিনি কেবল এক ইলাহ আর তোমরা যা শরীক কর আমি নিশ্চয় তা থেকে এই দুই সাক্ষী প্রদানের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানব জীবনের মূলনীতিই ঘোষণা করা হয় । যে ব্যক্তি এ কালেমা কবুল করে সে আসলে দুটো এমন মৌলিকনীতি মেনে নেয় যা তার সারা জীবন আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী চলার জন্য জরুরী।
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” দ্বারা ঘোষণা করা হয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না- অর্থাৎ আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কারো কথাই মানবো না। এটাই প্রথম নীতি। হাদীসে একথাটিকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে:
لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق
“স্রষ্টাকে অমান্য করে সৃষ্টিজগতের কারো আনুগত্য চলবে না” ।
২৪. সুরা আল ইমরান ৩:১৮।
২৫ সুরা আনআম ৬:১৯।
২৬ জামেউল আহাদীস: হা: ১৩৪০৫, মুয়াত্তা: হা: ১০, মু'জামূল কাবীর হা: ৩৮১, মুসনাদে শিহাব: হা: ৮৭৩ আবি শাইবা: হা: ৩৩৭১৭, কানযুল উম্মাল: হা: ১৪৮৭৫।
অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্যের বিপরীত আর কারো হুকুম মানব না – একথাই প্রথম নীতি ।
সাক্ষীর দ্বিতীয় অংশে “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” এর মাধ্যমে দ্বিতীয় মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মর্মকথা হলো, “আল্লাহর আনুগত্যের বাস্তব যে রূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখিয়ে গেছেন, একমাত্র সে নিয়মেই (তরীকায়) আল্লাহর হুকুম মানবো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কারো কাছ থেকে আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্বের নিয়ম গ্রহণ করবো এভাবে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরীকা অনুযায়ী জীবন চলার সিদ্ধান্তই কালেমার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এ সিদ্ধান্ত জীবনের সব ব্যাপারে পালন করাই কালেমার অপরিহার্য দাবী। কথায় ও কাজে, চিন্তায় ও বাস্তবে সবসময় এবং সব অবস্থায় এ নীতি মানার ইচ্ছাই এ কালেমার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় ।
সুতরাং এভাবে বুঝে-শুনে যারা কালেমার সাক্ষ্য প্রদান করে তাঁরাই প্রকৃত অর্থে মুসলিম। নফসের দুর্বলতার দরুণ বা শয়তানের ধোঁকার ফলে মুসলিম হয়েও আল্লাহর হুকুম বা রাসূলের তরীকার অমান্য হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সর্বদা, সকল বিষয়ে আল্লাহ (সুব:) ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্য করাই যে মুসলিমের কর্তব্য এবং কালেমার দাবী সে কথা সরল মনে স্বীকার করতেই হবে। অন্যথায় কেউ ঈমানদার ও মুসলিম হিসেবে আল্লাহর নিকট গণ্য হতে পারবে না। এই বিশ্বাসের সাথে যে ইসলাম কবুল করবে, তাঁর দ্বারা আল্লাহর হুকুম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরীকা বিরোধী কোন কাজ হয়ে গেলেও সে অবশ্যই তাওবা করবে, মাফ পাওয়ার আশা করবে এবং ভবিষ্যতে এধরণের অন্যায় আর না করার সংকল্প গ্রহণ করবে ।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন